টাইফয়েড জ্বর হলে করণীয় এবং দ্রুত সেরে ওঠার উপায়।

টাইফয়েড জ্বর হলো একটি ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগ। টাইফয়েড জ্বর "Salmonella Typhi" ব্যাক্টেরিয়ার কারণে হয়। টাইফয়েড হলে শুধু জ্বর হয় না এর পাশাপাশি অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয়। টাইফয়েড একটি পানিবাহিত রোগ। এই রোগের ব্যাক্টেরিয়া সাধারণত দূষিত পানি এবং খাদ্যের মাধ্যমে ছড়ায়।
টাইফয়েড জ্বর হলে করণীয় এবং দ্রুত সেরে ওঠার উপায়।জানবো আমরা। janbo amra
টাইফয়েড জ্বর হলে করণীয় এবং দ্রুত সেরে ওঠার উপায়।

সূচিপত্রঃ টাইফয়েড জ্বর হলে করণীয় এবং দ্রুত সেরে ওঠার উপায়।

ভূমিকাঃ
টাইফয়েডের জীবাণু কোনভাবে শরীরে প্রবেশ করলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্রুত এর চিকিৎসা না করলে টাইফয়েড রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং বিশেষ কিছু খাবার গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। টাইফয়েড জ্বর কিভাবে হয়, এর লক্ষণ, প্রতিকার, এই সময়ে রোগীর জন্য বিশেষ কিছু খাবার এবং বাড়তি সতর্কতা এসব নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা।

টাইফয়েড জ্বর কেন হয়

"Salmonella Typhi" নামক ব্যাকটেরিয়ার জন্য টাইফয়েড হয়। যুক্তরাজ্যের NHS (National Health Services) এর তথ্য অনুসারে Salmonella Typhi হলো ফুড পয়জনিং সৃষ্টিকারী একটি ব্যাকটেরিয়া। একজন সংক্রমিত ব্যক্তি যে বাথরুম ব্যবহার করে সেই বাথরুম যদি একজন সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করে তাহলে সেও সংক্রমিত হতে পারে। টাইফয়েড এর জীবাণু কারো শরীরে প্রবেশ করলেই তার যে টাইফয়েড হবে এমনটা না।

টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে যে সব মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। অপরদিকে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম অথবা ডায়াবেটিস, এইচআইভি এবং দীর্ঘদিনের গুরুতর কোন অসুখ থাকে তাদের টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। টাইফয়েডের ঝুঁকি বেশি থাকে অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ছোট বাচ্চাদের টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

টাইফয়েড জ্বর এর লক্ষণ

টাইফয়েডের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার ৬-৩০ দিন পর এর লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। লক্ষণ গুলি মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে। বিনা চিকিৎসায় একজন মানুষের সপ্তাহ বা মাসখানেক ধরে লক্ষণ থাকতে পারে। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হলোঃ
  •  টানা জ্বর হয় (জ্বর ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট  পর্যন্ত উঠতে পারে)
  • প্রচন্ড মাথা ব্যথা হয় 
  • বমি বমি ভাব হয় বা বমি হয় 
  • সম্পূর্ণ শরীর ব্যথা করে 
  • প্রচন্ড কক বা কাশি হয় 
  • শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে 
  • ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় অর্থাৎ খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না 
  • পেটে প্রচন্ড ব্যথা হয় 
  • কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া হয় 
  • মাথা ভারী হয়ে থাকতে পারে 
  • শরীরে অলসতা আসে 
  • পেটের উপরের দিকে পা পিঠে লালচে দাগ দেখা যায় 
  • শরীরের তাপমাত্রার সাথে হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে 
  • জ্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর পিঠে ও পেটে গোলাপি রঙের দানা অর্থাৎ ফুসকুড়ি দেখা যায় 

টাইফয়েড জ্বর শনাক্তকরণ 

টাইফয়েড সাধারণত রক্তের "ব্লাড কালচার" নামক পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষকরা নতুন একটি পদ্ধতির সম্পর্কে জানিয়েছেন। টাইফয়েডের ব্যাক্টেরিয়া যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন রক্তের কোষীয় অংশে এক ধরনের পরিবর্তন হয়।

নতুন এই পদ্ধতিতে রক্তের কোষীয় অংশের নমুনা পরীক্ষাগারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা রাখা হয়। এই সময় অতিবাহিত হবার পর নমুনাটির পরিবর্তন দেখে টাইফয়েড শনাক্ত করা হয়। রক্তের এই নমুনায় টাইফয়েড এর জীবাণুর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়াই দেবতার প্রভাবে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখে রোগটি নির্ণয় করা হয়। এই নতুন পদ্ধতিতে সাধারণত খুবই অল্প পরিমাণ রক্তের নমুনা (মাত্র এক মিলি লিটার ) থেকে রোগ নির্ণয় করা হয়। ছোট বাচ্চাদের কাছ থেকে খুব কম পরিমাণ রক্ত পাওয়া যায় বলে এই নতুন পদ্ধতিতে টাইফয়েড শনাক্তকরণ খুব সহজ হয়।

ব্লাড কালচার পদ্ধতিতে সাধারণত ৩০-৭০ ভাগ টাইফয়েড শনাক্ত করা যায়। অনেক সময় চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন না যে টাইফয়েড হয়েছে কিনা সেই ক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তারা। নতুন পদ্ধতিতে শরীরে জীবাণুর আক্রমণে রক্তের কোষীয় অংশে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি চিহ্নিত করার মাধ্যমে খুব সহজেই এই রোগ শনাক্ত করা যায়।

অন্যান্য সংক্রমনের ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয় বা দ্রুত হ্রাস পায়। কিন্তু টাইফয়েড এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। টাইফয়েডের ক্ষেত্রে ওষুধ শুরু করার পরেও এক সপ্তাহ পর্যন্ত জ্বর থাকতে পারে। টাইফয়েড জ্বরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।

টাইফয়েড এর জটিলতা

টাইফয়েড এর ফলে কি কি সমস্যা হয় বা কি কি লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো আমরা উপরে দেখেছি। এখন আমরা জানবো টাইফয়েড গুরুতরও অবস্থায় গেলে মানবদেহে কি কি সমস্যা দেখা দেয়। টাইফয়েডের জটিলতা তাদের ক্ষেত্রে বেশি হয় যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম। টাইফয়েড যখন ভয়াবহ আকার ধারন করে তখন যেসব অঙ্গের ক্ষতি সাধন হয় তাহলোঃ
  • টাইফয়েডের জীবাণু দ্বারা মেরুদন্ডে সংক্রমণ হয়।
  • পিত্তথলিতে সংক্রমণ হয়।
  • পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোড়া বা ফুসকুড়ি হয়।
  • অগ্নাশয়ে প্রদাহ হয়।
  • মস্তিষ্কে প্রদাহ হয়।
  • নিউমোনিয়াও হতে পারে।
  • স্নায়বিক সমস্যা দেখা দেয়।
  • কিডনিতেও বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর এর চিকিৎসা 

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কোর্সের মাধ্যমে টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা সফলভাবে করা যায়। টাইফয়েড জ্বর ধরা পড়লেই যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এমনটা না। টাইফয়েড জ্বর তারা সংক্রমিত ব্যক্তি তার বাড়িতেও চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে যদি রোগীর অবস্থা খুবই গুরুতর হয় সে ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হবে।


যদি কোন রোগীর প্রাথমিক অবস্থাতেই টাইফয়েড নির্ণয় হয়ে থাকে তখন চিকিৎসক তাকে ৭ থেকে ১৪ দিনের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের একটি কোর্স লিখে দেন। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন হাতুড়ি ডাক্তার বা স্থানীয় কোন ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে এনে খাওয়া মোটেও ঠিক না এতে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।


প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স রোগীর টাইফয়েড এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার পরে যদি কিছুদিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু এরকম ভুলেও কখনো করা যাবে না। শরীরে থাকা সম্পূর্ণ ব্যাটারিকে মেরে ফেলার জন্য অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পূর্ণ ডোজ শেষ করতে হবে।

টাইফয়েড রোগীর জন্য খাবার তালিকা

টাইফয়েড দ্বারা সংক্রমিত হবার পর যেহেতু ডায়রিয়া বা পেটের সমস্যা হয় তাই রোগীর খাবারের দিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হয়। যে খাবারগুলো সহজে হজম হয় সেই খাবারগুলো খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। নিচে টাইফয়েড রোগীর জন্য কিছু খাবার তালিকা দেওয়া হলো ঃ

  • কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার সাধারণত হজমে তেমন কোন সমস্যা হয় না। এইজন্য কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার হিসেবে আলু সিদ্ধ ও ভাত খাওয়ানো যেতে পারে। এই খাবার সহজে হজম হবে এবং শরীরে প্রয়োজনে পুষ্টি ও আসবে। 
  • টাইফয়েড রোগীর ডায়রিয়া হওয়ায় শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এজন্য অনেক পানি খাওয়া প্রয়োজন পরে। পানি খাওয়ার পাশাপাশি ফলের রস খেলেও পানিশূন্যতা কাটে। এজন্য বিভিন্ন ফলের রস খাওয়াবেন। 
  • ডাবের জল খেতে হবে। শরীরে যত তরল ঢুকবে শরীর থেকে টক্সিন বের হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। 
  • টাইফয়েড জ্বরের আক্রান্ত হওয়ায় রোগী অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে এজন্য এই সময়ে দুগ্ধজাত খাবার বেশি খাওয়া উচিত। এতে শরীরে শক্তি আসবে এবং শরীরের দুর্বলতা আস্তে আস্তে কাটবে। 
  • তারপর জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে সুপ বা ছাকা সবজি সুপ খেতে দিন।
  • টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে শুকনো আঙ্গুর খাওয়াতে হবে। টাইফয়েডের পর রোগীর শরীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে শুকনো আঙ্গুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 
  • মাছ বা দেশি মুরগির মাংসের ঝোল রোগীকে  খাওয়াবেন। 
  • তুলসী, গোলমরিচ, লবঙ্গ এগুলো খাওয়াতে হবে রোগীকে। তুলসী ও লবঙ্গ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। তুলসী পাতা ধুয়ে নিয়ে এরসাথে মধু বা আদার রস এবং গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে রোগীকে খাওয়াবেন। 

টাইফয়েড রোগীকে যেসব খাবার দিবেন না 

  • টাইফয়েডের রোগীকে তৈলাক্ত খাবার দেওয়া যাবে না। 
  • মোটা চালের ভাত যেহেতু সহজে হজম হয় না এজন্য মোটা চালের ভাত খাওয়ানো যাবে না 
  • মাখন, ঘি, শক্ত পনির, ক্রীম জাতীয় খাবার খাওয়ানো যাবে না। 
  • খাসির মাংস, গরুর মাংস বা মাংসের চর্বি কোন ভাবে রোগীকে খাওয়ানো যাবে না। 
  • বিস্কিট, জাঙ্ক ফুড, ভাজা কোন খাবার রোগীকে দিবেন না। 

টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে করণীয় 

টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের সবথেকে ভালো উপায় হলো টাইফয়েড জ্বরের ভ্যাকসিন নেওয়া। ভ্যাকসিন হিসেবে ইনজেকশন বা মুখে খাওয়ার দুই রকমই বাজারে পাওয়া যায়। টাইফয়েড জ্বরের ভ্যাকসিন গ্রহনের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 ভ্যাকসিন নিলেই যে একজন ব্যক্তি ১০০% টাইফয়েড জ্বর হতে সুরক্ষিত থাকবে তা না। ভ্যাকসিন নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। এই বিষয়গুলো নিয়ে এখন আপনাদের সাথে আলোচনা করা যাক। 

  • বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। যারা পানি সংরক্ষণ করে রাখে তারা অবশ্যই ২৪ ঘন্টার মধ্যে সে পানি পান করুন যাতে পানিটি দূষিত হতে না পারেন।
  • রাস্তার পাশের দোকানের খোলা পানি বা রাস্তার পাশে যে সব দোকানে খাবার থাকে সেসব খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
  • টয়লেট বা বাথরুম সবসময় পরিষ্কার রাখুন।
  • রান্নার পূর্বে শাকসবজি, এবং রান্নার বাসনপত্র পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিন। 
  • খাবার তৈরি, খাবার গ্রহণ এবং পরিবেশনের পূর্বে অবশ্যই আপনার হাত ভালো করে ধুয়ে দিতে হবে।
  • যেকোনো খাবার ভালো করে রান্না বা সিদ্ধ করে খাবেন। 
  • টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করুন 

শেষ কথা 

টাইফয়েড জ্বর সাধারণত দূষিত পানি বা খাদ্যের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনে হয়ে থাকে। টাইফয়েড জ্বর দ্বারা আক্রান্ত রোগী সম্পূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ডোজের মাধ্যমে সুস্থ হয়। টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের জন্য আপনি ভ্যাকসিন নেওয়ার পাশাপাশি সবসময় খাদ্য ও পানির বিষয়ে সচেতন থাকুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

জানবো আমরা ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url